রাজনীতি’র একাল সেকাল

আমি কোন রাজনীতিবিদ নই। ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলাম শখের বশে। কোন আদর্শের জন্য নয়। আমার ক্ষুদ্র মস্তিস্কে যা কিছু দেখার সুযোগ হয়েছে তাতে জেনেছি আমাদের দেশের রাজনীতি কি এবং কেন?

দেখা গেছে মফস্বল থেকে এসে একজন ছাত্র বিশাল ঢাকা শহরের বিশাল পরিসরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ভর্তি হয় বেচারা প্রথম কিছুদিন একেবারে গোবেচারার মত সাধারন জীবনযাপন করে। হল ক্যান্টিন কিংবা গেটের পাশের ছাপড়া হোটেলে বনরুটি, কলা, চা দিয়ে নাস্তা সেরে স্টার সিগারেট ধরিয়ে খাতা বগলে চেপে ক্লাসে যাওয়া। ক্লাস শেষে হলে ফিরে ডাইনিংএ খেয়ে দুপুরে ঘুম, বিকেলে সেজে গুজে মেয়েদের হলের সামনে ঘুরাঘুরি করা, এই হচ্ছে শুরু’র জীবন।

এই ধরনের মানুষগুলি তখন হলের পাতি ছাত্র নেতাদের চোখে পড়ে যায়। এরা এই বোকাসোকা সহজ সরল ছাত্রদের সিঙ্গেল রুম, হল ক্যাফেটেরিয়ায় ফ্রি খাবারের সুযোগ এসব লোভ দেখিয়ে নিজের দলে ভিড়ায়। আর দলে না ভিড়েও কোন উপায় নাই। যোগ না দিলে মার খাওয়ার সমুহ সম্ভাবনা, সিট হারানো সহ হল থেকে বিতাড়িত হতে হয়।

এভাবে শুরু হতে দেখেছি একজন যুবকের রাজনীতিতে হাতেখড়ি হতে। সেখানে কোন আদর্শের ব্যাপার নাই। দলে যোগ দিয়ে সহজ সরল যুবক ছেলেটি খুব দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে। পরিবর্তন হতে থাকে পোশাক আশাক, চাল চলন, কথা বার্তা সব কিছু। যে ছেলের জন্য তার কৃষক বাবা গ্রাম থেকে প্রতি মাসে ২/৩ ‘শ টাকা পাঠাতো সেই ছেলে আর ওই সামান্য টাকার জন্য মাস শুরুতে কখন ডাকপিয়ন আসবে মানি অর্ডার নিয়ে, তার জন্য অপেক্ষা করেনা।

যুবক নিজেই তখন দলবল নিয়ে ঘুরার মজা পেয়ে যায়। হাত খরচের জন্য পয়সা পায় দল থেকে। আর যদি একটু বেশি সাহসী ভুমিকা পালন করে যেমন অন্য দলের ছেলেদের মাথা ফাটিয়ে দিতে পারে কিংবা মিছিলের সামনে থেকে জোরালো শ্লোগান দিতে পারে, হরতালের সময় গাড়ি জ্বালাতে পারে তাহলে ওই ছেলের ভবিষ্যত খুব উজ্জ্বল হয়ে যায়।

ছেলের সাহসিকতার খবর পৌঁছে যায় বড় নেতাদের কানে। ওরা ওকে ডেকে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বড় দায়িত্ব দেয়। ছেলের কোমরে তখন ছোটখাট ছুরি,ক্ষুর এসব নয়, শোভা পায় আগ্নেয়াস্ত্র। বলা যায় মানুষ খুন করার অলিখিত লাইসেন্স পেয়ে যায়।

ছেলের তখন আর রেগুলার ক্লাসে যেতে হয়না। টিচাররাও চিনে ফেলে। তারাও তাকে আর ঘাটায় না বরং নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে। ছেলে তখন কিছু ছাত্র কিছু অছাত্র নিয়ে নিজের বাহিনী গড়ে তোলে। সব সময় নেশাষক্ত থাকে। আশেপাশের দোকানপাট , মার্কেট থেকে চাঁদা উঠায় জোর করে। ভার্সিটির কোন কাজে কন্ট্রাক্টরদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা নেয় নইলে কাজ বন্ধ করে দেয়। এরা এইসব অকাজে খ্যাত হয়ে পার্টির প্রিয়জন হয়ে যায়। হল কমিটি, নগর কমিটি, একপর্যায়ে কেন্দ্রীয় কমিটির ক্ষমতাধর নেতা হয়ে যায়।

এরা তখন আর ছাত্রের ইমেজ থেকে খুব দ্রুত কেন্দ্রিয় রাজনীতির খেলায় চলে আসে। হয়ে যায় সংসদ সদস্য, প্রতি মন্ত্রী, মন্ত্রী। আমার লাইফ টাইমে এই চিত্র আমি নিজে দেখেছি। সাধারন ছাত্র থেকে প্রতিমন্ত্রী মাত্র ১৫/২০ বছরের সময়ের ব্যবধানে।

একজন নিয়মিত ছাত্র সময় মত পড়াশুনা শেষ করে চাকুরি করে ২০ বছরে খুব বেশি হলে ব্যাঙ্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট, সরকারি চাকুরিতে উপসচিব, দুই চারজন যুগ্ম সচিব পর্যায়ে পৌঁছায়। সৎ জীবন যাপন করলে এরা ব্যাঙ্ক লোন নিয়ে হয়ত একটা গাড়ি, ক্ষেত্র বিশেষে ছোট একটা ফ্ল্যাটের মালিক হয়। কিন্তু রাজনীতি করা ছেলেটা যে কিনা গ্রাম থেকে এক জোড়া টেট্রনের সার্ট প্যান্ট আর টিনের স্যুটকেস জীবনে প্রথম ঢাকায় হলে এসে উঠেছিল, বিশ বছরের ব্যবধানে সেই ছেলে দেশের কোন বড় দলের কেন্দ্রীয় নেতা, নিজ এলাকার সাংসদ, প্রতিমন্ত্রী হয়ে যায়। সেই ছেলে দেশের সবচেয়ে দামী এলাকায় দুই চারটা এপার্টমেন্ট, একাধিক শিল্প কারখানার মালিক হয়ে যায়। এরা সফেদ কাপড়চোপড় পড়ে তেল চকচকে চেহারা নিয়ে টি,ভি’র টক শোতে আসে। এদের কপালে নামায পড়ার কালো দাগ দেখা যায়। বড় বড় নীতিবাক্য আওড়ায়। এরাই আবার স্বপরিবারে ঈদের অনুষ্ঠানে টিভিতে আমন্ত্রিত হয়ে আসে। এদের ছেলেমেয়েরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইয়োরোপ আমেরিকায় ফুল টিউশন ফি দিয়ে পড়াশুনা করে। ইংরেজি উচ্চারনে বাংলা বলে। সেটা শুনে বাবা বিশাল সন্তুষ্টির হাসি হাসে। এরা হল আমাদের দেশের আইন প্রনয়নকারী, দেশের কান্ডারী। এরা যখন টি,ভি’তে কথা বলে দেখা যায় নিজের মাতৃভাষাও শুদ্ধভাবে গুছিয়ে বলতে পারেনা। শুধু পারে দলপ্রধানের পা চাটা মুলক কথা বলতে। পাব্লিক টেলিভিষনে উগ্রভাবে কথা বলতেও তারা দ্বিধা করেনা।

এরা যখন বিদেশে আসে রাষ্টের খরচে বিনা কারনে, দুই হাতে পানির মত পয়সা উড়ায়, শপিং করে। কিন্তু কখনো হোটেলে থাকবেনা। উঠবে নিজের এলাকার কোন বোকা খেটে খাওয়া মানুষের বাসায়। তার কাজ, সময়, পয়সা সব কিছুর বারোটা বাজিয়ে তারপর দেশে ফিরে যায় অনেক কয়টা লাগেজ ভর্তি সব বড় ব্রান্ডের জিনিস্পত্র নিয়ে যা কিনা অনেক সত্যিকারের বিত্তবান মানুষেরাও সহজে কিনে না।

আমার বাবা রাজনীতি করতেন। বাবা’কে দেখেছি দাদা’র কাছ থেকে পাওয়া গ্রামের জমি বিক্রি করে ইলেকশন করতে। বাবা অনেক বড় মাপের রাজনীতিবিদ ছিলেন। ক্ষমতাও কম ছিল না। কিন্তু হাউজ বিল্ডিং এর লোন নিয়ে বানানো একমাত্র বাড়ির লোন শোধ করতে না পেরে বাড়ি বিক্রি করে লোন শোধ করেন। আমরা অনেক কয়জন ভাইবোন। বাবা’র সূযোগ থাকা সত্ত্বেও নিজের পরিবারের জন্য কিছুই করেন নাই। মনে আছে বাবা’র সাথে সবাই ভাত খেতে বসতাম। কখনো এক টুকরার বেশি মাংশ ভাগে পড়ত না।

শিখিয়ে গেছেন নিজের জন্য না করে মানুষের জন্য করতে। আমাদের বাবা আমাদের সব ভাইবোনদের শুধু পড়াশুনা করিয়ে দিয়ে গেছেন। বৈষয়িক কিছু দিয়ে যেতে পারেন নাই। আজ আমাদের ভাইবোনেরা সবাই যে যার জীবনে প্রতিষ্ঠিত। সবার হয়ত পাঁচ দশটা ফ্ল্যাট নাই। আছে অফুরন্ত শান্তি আর মিল। তাই বাবাকে নিয়ে আমরা গর্ব করি।

বাবাদের সময়ে ওনারা রাজনীতি করতেন নিজ এলাকার মানুষের কল্যানের জন্য। দেশের কল্যানের জন্য। নিজের কথা কখনো ভাবতেন না। আর এখন মানুষ রাজনীতি করেন নিজের জন্য, দেশের জন্য নয়। রাজনীতি এখন আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় আয়ের উৎস। বিনা পুঁজিতে বিশাল অর্জনের অব্যর্থ উপায়।

বিদেশে মানুষ খুব লটারির টিকেট কিনে যদি পেয়ে যায় মিলিওন ডলারের প্রাইজ মানি এই আশায়। এদের স্লোগান হল – Try it. Hey you never know.

আমাদের দেশে রাজনীতির লটারি কখনো মিস যায়না যদি মাথায় বুদ্ধি থাকে। তারজন্য অনেক লেখাপড়ার দরকার হয়না। জবাবদিহিতার দরকার হয়না। নিজ পরিবারের কাছে লজ্জা পেতে হয়না।

শুধু জানতে হয় কেমন করে পা চাটতে হয়। চাটার কাজটা ঠিকমত করতে পারলে সে পৌঁছে যাবে ক্ষমতার তীর্থস্থানে। তখন পুরন হয়ে যায় জীবনের আসল উদ্দেশ্য আর সেটা হল আমারটা আমার, দেশের টাকাও আমার।’

অক্টোবর ৪, ২০১৩