কামালের সাথে কলকাতায়

শুধু মনে আছে সবাই সব সময় সাধারণ শার্টপ্যান্ট পরে আসে কিন্তু কামাল মাঝে মাঝে স্যুট-টাই পরে আসতো ইউনিভার্সিটিতে। ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক ছিল না।

প্লেনে প্রথম ওঠার অভিজ্ঞতা হবার অনেক আগে ছোটবেলায় আমি একবার হেলিকপ্টারে উঠেছিলাম। কতই বা বয়স হবে তখন, পাঁচ কি ছয়।

আমাদের দেশটা তখন পূর্ব পাকিস্তান ছিল। বাবা অনেক বড় সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন। বাবার সাথে তেজগাঁও এয়ারপোর্ট থেকে হেলিকপ্টারে চড়ে হাতিয়ায় আমাদের গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম। ভ্রমণের বৃত্তান্ত মনে নাই। এইটুকু শুধু মনে আছে—যান্ত্রিক ফড়িং উড়াল দেয়ার আগে ওরা আমাকে অরেন্‌জ স্বাদের হার্ড ক্যান্ডি খেতে দিয়েছিল অনেকগুলি। মনের আনন্দে ক্যান্ডি খেয়ে শেষ করার আগেই পৌঁছে গিয়েছিলাম গ্রামের বাড়িতে। আমাদের বাড়ির ঈদগাহ মাঠে নেমেছিল হেলিকপ্টার।

ফড়িং থেকে নামার আগে বাইরে তাকিয়ে দেখি কত মানুষ ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে । ফড়িংয়ের পাখার বাতাসে সবার গায়ের কাপড় নড়ছে। পাশের ধানক্ষেতে যেন বাতাসের ঢেউ উঠেছে এমন করে কাঁপছিল ধানের সবুজ মাঠ। ব্যাস, এইটুকুই মনে আছে।

১৯৮১ সালের কথা। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ি সেকেন্ড ইয়ারে। দুই টাকা ভাড়ার দূরত্বে বাসা হলেও সূর্যসেন হলে থাকি, বন্ধুদের সাথে গ্রুপ স্টাডি করার সুবিধা দেখিয়ে। যুবা বয়সে পারিবারিক কারাগার থেকে বের হয়ে কোনো বাধা, শাসন, নিয়মকানুনবিহীন স্বাধীন জীবনের পূর্ন স্বাদ নিচ্ছিলাম বিরামহীনভাবে।

বাসা ছাড়ার আগে ঢাকার বাইরে বলতে শুধু বাবার সাথে গ্রামের বাড়ি যাওয়া ছাড়া আর কোথাও যাওয়া হয় নাই। হলে এসে প্রথম বছরেই দল বেঁধে যশোরে গিয়েছিলাম বন্ধু ফজলুর বিয়ে খেতে। তারপর সেখান থেকে খুলনা, মংলা, সুন্দরবন দেখে ঢাকায় ফিরেছিলাম।

হলে থাকি, মোবাইল ফোন ছিল না, ল্যান্ড ফোনেও খবর নেয়ার ব্যবস্থা বা নিয়ম ছিল না। তাই বাসা থেকে কেউ কখনো খোঁজ করে জানতে পারত না আমি কখন কোথায় কী করছি। এটা আমার জন্য মহা সুবিধাজনক ব্যাপার ছিল।


সূর্যসেন হল ক্যাফেটারিয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু বাচ্চু, আমি, কামাল ও পিন্টু। (১৯৮০) 

রায়ের বাজারের ছেলে কামাল আমার সাথে এক ডিপার্টমেন্টেই পড়ে। আমার মত সেও বাসা ছেড়ে হলে থাকে। তবে এক হলে নয়, কামাল থাকে মহসীন হলে। কেমন করে বন্ধুত্ব গভীর হয় সেটা মনে নাই। শুধু মনে আছে সবাই সব সময় সাধারণ শার্টপ্যান্ট পরে আসে কিন্তু কামাল মাঝে মাঝে স্যুট-টাই পরে আসতো ইউনিভার্সিটিতে। ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক ছিল না। সবাই খুব বলাবলি করত কামাল ব্যবসা করে। এই বয়সে ছাত্রাবস্থায় কেউ ব্যবসা করতে পারে এটা আমার মাথায় ঢুকত না।

ক্লাস শেষ হবার পর একদিন কামাল আড্ডা মারতে আমাদের সাথে সূর্যসেন হলে এল। তখন গল্পচ্ছলে জানা গেল, কামাল প্রায়ই ইন্ডিয়ায় যায়। ওই দেশ থেকে নানা রকম মাল কিনে এনে ঢাকা নিউমার্কেট, এলিফ্যান্ট রোডের দোকানগুলিতে সাপ্লাই দেয়। অনেক টাকা নাকি লাভ হয়।

একদিকে বিদেশ কেমন দেখতে সেই আগ্রহ, তার উপর কিছু কিনে এনে ঢাকায় বিক্রি করলে বেড়ানোর খরচ নাকি উঠে যায়—এমন শুনে আমার খুব ইচ্ছা করল কামালের সাথে বিদেশে বেড়াতে যেতে।

বললেই কি সব হয়ে যায় নাকি। একে তো বয়স অনেক কম—পাসপোর্ট, টাকা পয়সা অনেক কিছুর প্রয়োজন। তখন দুই রকম পাসপোর্ট বানানো যেত। আন্তর্জাতিক যেটা বানাতে পয়সা বেশি লাগত। আবার কম ফি’তে শুধু ইন্ডিয়া যাওয়ার জন্য স্পেশাল পাসপোর্ট বানানো যেত। এই ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। কামাল আমার সমবয়সী হলেও আমার চাইতে ওর বুদ্ধিশুদ্ধি অনেক বেশি এবং বাইরের জগৎ সম্পর্কে ভাল জানত।

কামাল জানাল, আমি যেতে চাইলে পাসপোর্ট-ভিসা এসব সে ম্যানেজ করে দিবে। আমাকে শুধু খরচ দিতে হবে। এটাও জানাল, ইন্ডিয়ার সব কিছু তার নখদর্পনে। আমাকে কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।

আমার সেই সময়ের চিরাচরিত অব্যর্থ পন্থায় বাবাকে গিয়ে বললাম বেশ কিছু বই কিনতে হবে। এটা বলে হাজার খানেক টাকা ম্যানেজ করে কামালের মাধ্যমে শুধু ভারত ভ্রমণের পাসপোর্ট বানিয়ে ফেললাম। আসল ভিসার জন্য সেই সময়ে সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে ভারতের অ্যাম্ব্যাসিতে অনেক ভোরবেলায় গিয়ে লম্বা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। কামাল জানাল, এত ঝামেলার কোনো দরকার নাই। নকল ভিসা কেনা যায় অল্প কিছু টাকা দিয়ে। এমন কোনো পার্থক্য নাই আসল আর নকল ভিসায়, কারণ অ্যাম্ব্যাসির লোকেরাই এসব করে। অগত্যা নকল ভিসা লাগানো হল আমার পাসপোর্টে। প্লেনের টিকেটের দাম তখন কত ছিল একজাক্টলি মনে নাই। তবে অনেক কম দাম ছিল।

টিকেটও কামালের পরিচিত ট্রাভেল এজেন্সি থেকে বাকিতে নেয়া হল। ফাইনালি আমার দরকার হাজার পাঁচেক টাকা।

বাবা আমাদের ছোট দুই ভাইয়ের নামে জনতা ব্যাঙ্কের মগবাজার শাখায় আলাদা করে নন চেকিং সেভিংস অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়ে পঞ্চাশ হাজার করে টাকা জমা রাখেন আমাদের ভবিষ্যতের জন্য। বাবার ধারণা ছিল, নন চেকিং অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা কেমন করে ওঠাতে হয় ছেলে কোনোদিন এসব বুঝবে না। কিন্তু তিনি ঘুণাক্ষরেও বোঝেন নাই যে তিনি শিয়ালরে মুরগির খোয়াড়ের ভাঙা বেড়া দেখায়ে দিলেন।

কামাল বলেছিল পাঁচ হাজার টাকা হলে নিজের থাকাখাওয়া, ঘোরাঘুরি, কেনাকাটা সব হয়ে যাবে। এবং কিছু মাল কিনে আনলে এই টাকা সুদে-আসলে উঠে আসবে। মনে মনে প্ল্যান আঁটছিলাম কেমন করে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা বের করা যায়। তারপর ইন্ডিয়া ঘুরে এসে অনেক লাভে মাল বিক্রি করে আবার সেই টাকা অ্যাকাউন্টে জমা দিয়ে দিব। বাবা কিছুই জানতে পারবে না।

কেমন করে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা উত্তোলন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা যায় এই ব্যাপারে রাতের বেলায় হলে আমার রুমে বন্ধুদের নিয়ে জরুরি মিটিংয়ে বসলাম। বন্ধু ফজলু আমাদের চাইতে বয়সে বেশ বড়। মাথায় অনেক চিকন বুদ্ধি আছে। সে জানাল, এটা কোনো ব্যাপারই না। বলে, “তোর টাকা তুই ওঠাবি, ব্যাঙ্কের তাতে কী!”

কিন্তু নন চেকিং অ্যাকাউন্ট থেকে কেমন করে টাকা ওঠাতে হয় এটা আমার জানা ছিল না। তখন ফজলু জানাল, এটাও কোনো জটিল কিছু নয়। ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের বরাবরে দুই লাইনের একটা অ্যাপ্লিকেশন লিখতে হয় যে জরুরি প্রয়োজনে নিজের নন চেকিং অ্যাকাউন্ট থেকে কিছু টাকা ওঠাতে হবে। ওটা দেখে ব্যাঙ্কের অফিসার ব্যাঙ্ক থেকে একটা চেক দেয় অ্যাকাউন্ট নাম্বার লিখে। সেই চেকে টাকার অঙ্ক লিখে সই করে দিলে সেটা সিগনেচার কার্ডের সাথে মিলিয়ে দেখে ‘ওকে’ করে হাতে দেয়। তারপর ক্যাশ কাউন্টারে গিয়ে টাকা উঠিয়ে নেয়া, ব্যাস, হয়ে গেল।

উপায় জানা গেল। কিন্তু এটা বাস্তবায়ন করা যত সহজ সবাই মনে করল, আমার কাছে অত সহজ মনে হচ্ছিল না। কারণ ব্যাংকের ব্রাঞ্চটা ছিল মগবাজার মোড়ে আমাদের বাসার পাশে। তার পাশেই ছিল বাবার সব চাইতে বিশ্বস্ত অনুচর চাচার দোকান। এই চাচার হাত দিয়েই বাবা ব্যাঙ্কের সব লেনদেন করতেন। শুধু তাই নয়, আমাদের উপর স্পাইগিরি করার দায়িত্বও ছিল এই চাচার অন্যতম কাজ। শিয়ালের মত ধূর্ত এই চাচার চোখ এড়িয়ে কেমন করে ব্যাঙ্কে ঢুকব এটা মনে হলেই আমার পেটে কামড় দিয়ে উঠল।

সব সমস্যা নিয়ে বন্ধুদের সাথে আলাপ হল। ওরাই সমাধান দিল। আমি মাথায় ক্যাপ, চোখে কালো চশমা পরে চাচার দোকান ক্রস করে ব্যাঙ্কে ঢুকব। আমার আরেক বন্ধু চাচার দোকানের সামনে পজিশন নিবে যাকে চাচা চেনে না। যদি কোনো কারণে চাচা দোকান ছেড়ে ব্যাঙ্কের দিকে যেতে চায়, যে কোনোভাবে হোক সে চাচাকে আটকাবে।

প্ল্যান মোতাবেক পরদিন মগবাজারে গেলাম। ব্যাংকের গেটে রিকশা ছেড়ে চোরা চোখে চেয়ে দেখি দোকানি চাচা কাষ্টমার নিয়ে ব্যস্ত। ঠিক তার উল্টাদিকে আমাদের দোতলা বাসার বারান্দা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেখানে কেউ দাঁড়িয়ে নাই। এই সময়ে বাবা তার ঘরে বসে পত্রিকা পড়ে, আমি জানি।

ব্যাংকে ঢুকে অফিসারের টেবিলে বসে আমার লিখে নিয়ে আসা আবেদনপত্রটা দিলাম। অজানা ভয়ে বুকের ভিতরের ধুক পুক আওয়াজ এত জোরে হচ্ছিল যে ভয় পাচ্ছিলাম ব্যাংকের অফিসার বেটা সেটা টের না পেয়ে যায়। দর দর করে ঘামছি এসির ভিতরে বসেও।

অফিসারের কথায় আমার ধ্যান ভাঙল। জিজ্ঞেস করল, কেন টাকা ওঠাচ্ছি আমি।

গলার স্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললাম, স্টাডি ট্যুরে ইন্ডিয়া যাব ডিপার্টমেন্ট থেকে। এই কথা কয়টা বলতেই আমার গলা বন্ধ হয়ে আসছিল। ভাবছিলাম, এই বুঝি বলে বসবে, দাঁড়াও, তোমার বাবাকে একটু ফোন করে জেনে নেই।

কিন্তু না, তেমন কিছুই করে নাই। উল্টা হাসি মুখে বলল, বাহ, ভেরি গুড। যাও দেখে এসো। কলকাতা অনেক ঐতিহাসিক শহর।

এই বলে ড্রয়ার টেনে লম্বা চেক বুক বের করে নিজেই সব লিখে টাকার অংক কত জানার জন্য আমার দিকে তাকাল। আমি বলার পর চেক লিখে আমাকে সই করতে বলল। আমার হাত এতই কাঁপছিল যে নিজের সই পর্যন্ত আঁকাবাঁকা হয়ে গেল। দেখে আমাকে আরেকবার সই করতে বলল। এবার ঠিক করে করলাম। সই মেলালো ড্রয়ারে রাখা সিগনেচার কার্ডের সাথে। তারপর আমার হাতে দিয়ে বলল ক্যাশ থেকে টাকা নিয়ে যেতে।

ওনাকে সালাম দিয়ে তাড়াহুড়ায় উঠতে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে পিছনের চেয়ার উল্টে ফেললাম। সেটা ঠিক করে রেখে ক্যাশ কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়ালাম। পাঁচশো টাকার নোট চাইলাম, আরো বললাম নতুন নোট দিতে। ক্যাশের লোকটা স্পন্‌জে আঙুল ভিজিয়ে এতবার করে টাকাগুলি গুনছিল আমার মনে হচ্ছে এটা শেষ হতে অনন্তকাল লাগবে। শেষ পর্যন্ত যখন হাতে পেলাম টাকা, নিজে আর না গুনে পকেটে ঢুকিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে বের হয়ে এলাম।


বেরিয়ে দেখি ফজলু তখনো দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। ওকে ইশারা করতেই দৌড়ে এসে রিকশায় উঠে বসল আমার পাশে। রিকশা যখন মগবাজার মোড় ছেড়ে দিলু রোডে পড়ল, তখন আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

ডলার কেনার দরকার হল না। কারণ ডলারের চাইতে ভারতে বাংলাদেশী পাঁচশো টাকার নোটের বেশি চাহিদা ছিল তখন। সমস্যা ছিল বাংলাদেশ থেকে দেশের টাকা বাইরে নিতে দেয় না। ঢাকা এয়াপোর্টে অনেক সার্চ করে।

কামাল জানাল, যেমন করে হোক টাকা লুকিয়ে নিতে হবে। ঢাকা এয়ারপোর্টে বডি চেক করে দেশী টাকা পেলে রেখে দিবে সব।

আমার একটা রাশিয়ান জেনিথ এসএলআর ক্যামেরা ছিল। তখন থেকেই ছবি তোলার অনেক নেশা ছিল। রঙিন ফিল্মের রোলের দাম অনেক বেশি ছিল। সাদা কালো অরিজিনাল রোল কিনলেও দাম কম নয়। তাই আমি ব্যবহার করতাম এফডিসি থেকে বের করে আনা রিফিল কার্টিজ। অনেক কম দামে পেতাম। এমন রিফিলের ভিতর থেকে ফিল্ম বের করে তার সাথে পাঁচশো টাকার নোট টেপ দিয়ে আটকে আবার রিওয়াইন্ড করে সেই রোল ক্যামেরায় লোড করে ফেললাম। আমার পেশাদার কায়দা ভালই কাজে দিল। আমি বিনা বাধায় এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন পার হয়ে গেলাম।

কামালের বুদ্ধিতে ডিউটি ফ্রি শপ থেকে বিদেশী মদের বোতল, সিগারেট কিনলাম। ভারতে নাকি এসবের ভাল ডিমান্ড। তারপর প্লেনে বোর্ডিংয়ের ডাক এলে আল্লাহ আল্লাহ করে বিমানের ঢাকা-কোলকাতা ফ্লাইটের উড়োজাহাজে উঠে বসলাম। জীবনের প্রথম প্লেনে ওঠার অভিজ্ঞতা আমার সেদিন।

খুব টেনশনে ভুগছিলাম কারণ শুনেছি প্লেন আকাশে ওঠার সময় কান বন্ধ হয়ে যায়, বুকের ভিতর উল্টানি খায় এসব ভেবে। আমার নার্ভাস চেহারা দেখে কামাল খুব হাসছিল। বলল, কিছুই হয় না এসব, চিন্তা করিস না।

প্লেন যখন রানওয়ে ছেড়ে আকাশে উঠতে শুরু করল, আমার কান বন্ধ হয় নাই, কলজেও উলটে যায় নাই। কিন্তু পুরনো প্লেন এত জোরে আওয়াজ করছিল—মনে হচ্ছিল আমি যেন প্লেনে নয় এগজস্ট পাইপ ভাঙা কোনো মুড়ির টিন বাসে করে গুলিস্তান থেকে নারায়নগঞ্জে যাচ্ছি। প্রচণ্ড জোরে আওয়াজ এবং কাঁপাকাঁপি করে এক সময় আকাশে উঠে স্থির হল আমাদের প্লেন। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে নড়েচড়ে বসলাম। জানালা দিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখি সব কিছু এত ছোট ছোট,মনে হল যেন ছোটবেলার স্কুলের বইয়ের ছবির মত সব।

বেশি সময় তাকানো লাগে নাই। কিছুক্ষণ পরেই ঘোষণা এল, আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্লেন দম দম এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করবে।

অবাক হয়ে কামালের দিকে তাকিয়ে বললাম, কীরে, এত কাছে নাকি কলকাতা? তাইলে হাঁইটা আইলেই তো পারতাম।

কামাল হো হো করে হেসে দিল আমার কথা শুনে।

কলকাতা এয়ারপোর্টের কাস্টমস খুব সুন্দর ব্যবহার করে নাই। এমন ব্যবহার করল যেন, আমরা ওখানে বেড়াতে যাই নাই পয়সা খরচ করে। বরং শরণার্থী হয়ে ওদের বিরক্ত করতে গেছি ইচ্ছার বিরুদ্ধে।

যাই হোক, ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে কামাল ট্যাক্সি ডাকল। উঠে নিউমার্কেটের পাশে হোটেলের নাম বলল। এত বছর পর এখন দেখতে কেমন হয়েছে জানি না। তখন ওদের রাস্তার দুই পাশে দেখার মত সুন্দর কিছু ছিল না। খুব জীর্ণশীর্ণ মনে হল। কামাল সব কিছুর সাথে আগে থেকেই পরিচিত। তাই সে বলে যেতে লাগল কোনটা কী। এক সময় ট্যাক্সি হোটেলে এসে পৌঁছালো। ভাড়া মিটিয়ে হোটেলে ঢুকে আমরা রুম নিলাম। দেখি কামাল অল্পবিস্তর হিন্দি বলে বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে। ওর হিন্দি শুনে মনে হল, বাহ, সে তো হিন্দি পারে, আমি তো কিছুই পারি না।

রুমে ঢুকে দেখি সাইজ আমার সূর্যসেন হলের রুমের চাইতে বেশি বড় নয়। একটা বেড। বেডের চাদর মনে হয় জীবনে কখনোই পাল্টায় নাই। হলে থেকে সব রকম অবস্থার সাথে পরিচয় আছে আমার। তাই এসব কিছু আমার খারাপ লাগে নাই। তাছাড়া কম পয়সায় থাকার জন্য এর চেয়ে ভাল হোটেল আর আশা করা যায় না।

ব্যাগ রেখে বসতে না বসতেই দুই তিনজন লোক আমাদের রুমে ঢুকে গেল কিছু জিজ্ঞেস না করেই। আমি তো অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি ব্যাপার না বুঝে। কামাল দেখি ওদের দিকে তাকিয়ে টাকার রেইট কত জানতে চাইছে। দরদাম করে টাকা, মদের বোতল, সিগারেট সব ওদের দিয়ে হিসাব করে ইন্ডিয়ান রুপি বুঝে নিয়ে ওদের বিদায় করল। কামালের এত করিৎকর্মা ভাব দেখে আমার খুব হিংসা হল।

কামাল চাইল রুমে কিছুক্ষণ রেস্ট নিতে কিন্তু আমার তর সইছিল না কলকাতা দেখার। তাছাড়া খুব ক্ষুধাও লাগছিল। দুপুর বারোটাও বাজে নাই। আমরা রুম বন্ধ করে বেরিয়ে গেলাম হোটেল থেকে।

হোটেল থেকে বের হয়ে পাশেই এক মুসলিম রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য। সাদা ভাত, ডাল, গরুর মাংস দিয়ে লাঞ্চ সারলাম। তারপর খেলাম অনেক মজার ফালুদা। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে নিউ মার্কেটের পাশ দিয়ে হাঁটছিলাম। রাস্তায় বসে আঙুর বিক্রি করছে। দেখে আমার চোখ কপালে উঠল। আমাদের দেশে তখন আঙুর সবচেয়ে দামি ফল। শাহবাগে বিক্রি করতে দেখেছি। এমন কি গোছা থেকে ঝড়ে পড়া দুই চারটা আঙুরও সুতা দিয়ে বেঁধে গোছার সাথে আটকে দেয়া হত যেন কোন বেহেশতি ফল।

এই আঙুর নিয়ে অনেক হাসির প্রবাদ আছে। তখন বলা হত আঙুর মরা মানুষের ফল। মানে মৃত্যুপথযাত্রী কেউ হাসপাতালের বেডে শুয়ে শেষ ইচ্ছা প্রকাশ করত আঙুর খাওয়ার। বলা হত দুই চারটা আঙুর মুখে দিয়েই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করত রোগী।

যাই হোক, সেই সময়ে দেশে আঙুর খুব দামি ফল ছিল। তাই খাওয়ার লোভ থাকলেও খাওয়া হত না। কলকাতার রাস্তায় এত কম দামে দায়সারা ভাবে আঙুর বিক্রি করতে দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। দেরি না করে এক ঠোঙা কিনে রাস্তায় হেঁটে হেঁটেই খেতে শুরু করে দিলাম আঙুর।

স্কুলজীবন থেকে বইয়ের পোকা ছিলাম আমি। বই পড়ায় কোন বাছবিচার ছিল না। যা পেতাম তাই পড়ে ফেলতাম। রোমেনা আফাজের দস্যু বনহুর, দস্যু বাহরাম, সেবা প্রকাশনীর কুয়াশা, তিন গোয়েন্দা, রহস্য পত্রিকা, ওয়েস্টার্ন, মাসুদ রানা থেকে শুরু করে নীহাররঞ্জন গুপ্ত, আশুতোষ, সমরেশ বসু, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিম কোনো কিছুই বাদ দিতাম না। ওপার বাংলার লেখকদের বই পড়তে পড়তে কলকাতার রাস্তাঘাটের নাম সব মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। কলকাতায় বেড়াতে গিয়ে রাস্তার নাম দেখেই মনে হচ্ছিল এ তো আমার চেনা জায়গা। যেন আগেও ওই রাস্তা দিয়ে কতবার আসাযাওয়া করেছি।

পার্ক স্ট্রিট, হাওড়া, টালিগঞ্জ, বালিগঞ্জ ঘুরে বেড়ালাম ট্রাম আর টাঙ্গায় চড়ে। গড়ের মাঠ, চিড়িয়াখানায় গেলাম। জীবনে প্রথম সিনেমা হলের বড় পর্দায় হিন্দি ছবি দেখলাম। ঢাকায় একটা বিয়ার খেতে কত তেলখড় পোড়াতে হয়। কলকাতায় এসে দেখি যে কোনো দোকানে বড় বড় বোতলে ভারতের তৈরি বিয়ার বিক্রি হয়।

নাইট ক্লাব, ডিসকোতে যাবার অভিজ্ঞতা আগে ছিল না। সন্ধ্যায় দুই বন্ধু মিলে নাইট ক্লাবে গেলাম। অবস্থা দেখে আমার তো চক্ষু ছানাবড়া। নারী-পুরুষ একসাথে বসে ড্রিঙ্ক করছে, গল্প করছে। কেউ কেউ জোড়া বেঁধে জড়াজড়ি করে নাচছে। রঙিন আলোতে সাজানো স্টেজে একজন লাইভ গান করছে মিউজিকের তালে তালে। সে এক মনোমুগদ্ধকর বিরল অভিজ্ঞতা।

তখন শুধু মনে হচ্ছিল ধর্মের দোহাই দিয়ে আমাদের দেশে লিকার, নাইট ক্লাব নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নিষিদ্ধ করে মানুষের ইচ্ছাকে চাপা দেয়া যায় না। যারা যা কিছু করার ঠিকই করছে। কিন্তু তার জন্য অনেক লুকোচুরি করতে হয়। অথচ লিকার যদি বৈধ হত, তাহলে মানুষ রাস্তাঘাটে বিদেশী মদের বোতলে স্পিরিট মেশানো পানীয় পান করে মরত না। জীবনের জন্য হুমকি খারাপ নেশায় জড়িয়ে ছারখার হয়ে যেত না। দেশে যারা এসব নিয়ম তৈরি করে তারা সবাই নিজের ঘরেই পানের ব্যবস্থা রাখে এমন দেখেছি। হিপোক্রেট আর কাকে বলে!

ঢাকা থেকে আসার সময় হলের বন্ধুরা পই পই করে বলে দিয়েছিল যেন চটি বই কিনতে ভুলে না যাই। কলাকাতার রাস্তায় নাকি সেরা চটি পাওয়া যায়। বিকেলে পার্ক স্ট্রিটের রাস্তায় হাঁটার সময় খেয়াল করেছি ফুটপাথে হরেক রকমের ম্যাগাজিন নিয়ে হকাররা বসে।

কামালকে বললাম, আমি তো হিন্দি পারি না তুই গিয়ে জিজ্ঞেস কর না, ওরা চটি বই বিক্রি করে কিনা।

কামাল বলে, আমি স্যুট-টাই পরা, আমি পারব না। তুই গিয়ে জিজ্ঞেস কর।

কী আর করা। সাহস করে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপকা পাস চটি-উটি হ্যায়?

বেটা আমার কথার কিছুই না বুঝে হা করে তাকিয়ে রইল। আশেপাশের মানুষও আমার দিকে তাকিয়ে দেখল। আমি একটু থতমত খেয়ে খেলাম। নানা রকমের বই ম্যাগাজিনের ভিড়ে আমার অভিজ্ঞ চোখ আলতা রঙের প্লাস্টিকে মোড়ানো চটি বই ঠিক খুঁজে বের করলো। দেরি না করে নিজেই সেটা উঠিয়ে নিয়ে দাম চুকিয়ে সেখান থেকে সরে এলাম। কাজটা করতে পেরে যেন অনেক বড় কিছু করে ফেললাম এমন একটা ফিলিং হল।

 

কামাল আর আমি 

নাইট ক্লাবে নাচানাচি দেখে, ড্রিঙ্ক করে অনেক খুশি মনে টাঙ্গায় চড়ে হোটেলে ফিরে এলাম।

বই কেনার সময় কামাল কোনো হেল্প করে নাই। কিন্তু হোটেলে আসার সাথে সাথে সে আমার কাছে বইটা চাইল। আমি হেসে ওকে বইটা দিলাম। কামাল পড়ায় মন দিল।

পরদিন কামালের সাথে ঘুরে ঘুরে ওর পরিচিত দোকান থেকে ব্যবসার জন্য জিনিসপত্র কিনে ফেললাম। দেখতে দেখতে আমার কলকাতা বেড়ানোর মেয়াদ শেষ হয়ে এল। অতপরঃ আমরা ব্যাগ গুছিয়ে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।

ঢাকায় নেমে মালপত্র ছাড়িয়ে নিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা সূর্যসেন হলে চলে গেলাম।

হলে পরিচিত পরিবেশে ফিরে এসে মনে হচ্ছিল আমি যেন যুগ যুগ ধরে কলকাতায় ছিলাম। বন্ধুরা কলকাতার গল্প শোনার চাইতে চটি বই এনেছি কিনা সেই খবর নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ওদের হাতে বই ধরিয়ে দিয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম আমার অনেক প্রিয় বিছানায়।

নিউইয়র্ক, ৭ মে ২০১৫