তেলাপোকার বংশধর

Cockroach ও Water bug দেখতে এক রকম বলে দুইটাকেই সবাই তেলাপোকা বলে ডাকে। পার্থক্য শুধু একটা পানির কাছাকাছি থাকে আরেকটা শুকনা ও উষ্ণ জায়গায় থাকে। কিন্তু মূলতঃ দুই প্রজাতির পোকার স্বভাব একই রকম। সেটা হল এরা রাতের অন্ধকারে চলতে সাচ্ছন্দ বোধ করে এবং খুব দ্রুত বংশ বিস্তার করতে পারে।

খুব সাবধান না হলে এক দুইটা তেলাপোকা অচিরে বিশাল আকারে বংশ বিস্তার করে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে যত্রতত্র। তখন জীবন হয়ে উঠে অসহনীয়। একবার বংশ বিস্তার করে বাড়িতে ছড়িয়ে পড়লে কোন এক্সটারমিনেটর এদের সমূলে নির্মূল করতে পারে না।

খেয়াল করলে দেখা যায়, এই পোকার জাত খুব দলবদ্ধ হয়ে চলে এবং নিজেদের ভিতর শৃংখলা বজায় রাখে। ওদের শৃংখলা আমাদের আতংক। আমি ব্যাক্তিগতভাবে খুব ঘৃনা করি এই তেলাপোকা। বাসায় যাতে কোনভাবেই এই পোকা না জন্মায় সেদিকে খুব সাবধান থাকি কিচেনের তেল চিটচিটে সব কিছু পরিষ্কার রেখে।

তেলাপোকা নিয়ে এত কথা বলার উদ্দেশ্য হল, আমাদের দেশে কিছু মানুষের ভিতর তেলাপোকার স্বভাব দেখি। আগেই বলেছি তেলাপোকা শুরুতে সমূলে উতপাটন করতে হয়। দেরী করে ফেললে আর কখনো এদের বিনাশ করা যায় না। আপাতঃ দৃষ্টিতে বিনাশ হয়েছে মনে হলেও কিছুদিন পরেই ভোজবাজির মত এদের আবার আবির্ভাব ঘটে।

দেশ বিরোধী, যুদ্ধাপরাধী হিসাবে চিহ্নিত ও স্বীকৃত – জামায়াতে ইসলামী দেশ স্বাধীন হবার পর জীবনের ভয়ে কেউ কেউ দেশ ছেড়ে, আত্মগোপন করে, কেউ বা জীবন হারানোর ভয়ে লুকিয়ে দিন কাটাতো। হ্যাঁ, অনেক রাজাকার, পাকি দালালদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, গ্রেফতার হয়েছে। আবার শেখ মুজিব অনেক অপরাধীকে ক্ষমাও করে দিয়েছে। কিন্তু তখন অনেক বড় একটা ভুল করা হয়েছে কিংবা বলা যায় ইচ্ছায়, অনিচ্ছায় যেভাবেই হোক এই ভুল কাজটা হয়েছে। সেটা হল, এই যুদ্ধাপরাধী দলকে চিরতরে নিষিদ্ধ ঘোষনা না করে।

১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন দেশে অনেক অতি প্রয়োজনীয় কাজ অবহেলা করে অপ্রয়োজনীয় কাজ করা হয়েছিল। স্বাধীনতার সনদ এর খসড়ায় অবদান রাখা অনেক হিতৈষীদের এক পাশে সরিয়ে রেখে, অবহেলা করে শুধু এক শ্রেনীর মানুষ সব কিছুর কতৃত্বে চলে যায়। যার প্রতিবাদ হিসাবে বঞ্চিত মুক্তিযোদ্ধাদের আয়োজনে আত্মপ্রকাশ করেছিল ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল’ (জাসদ) এবং তাদের সশস্ত্র বাহিনী যার নাম ছিল ‘গন বাহিনী।’

শেখ মুজিব বাকশাল বানিয়ে, রক্ষী বাহিনী দিয়ে জাসদ দমন করেছে। কিন্তু জামায়াতের কথা ভুলে গেছে। জাসদ তার গন বাহিনী দিয়ে মুজিব বিরোধী কর্মকান্ড চালিয়েছে। অনেক হত্যা করেছে কিন্তু তারাও জামায়াতের কথা ভুলে গেছে বেমালুম।

সাত কোটি মানুষের একমাত্র নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের উচিত ছিল ৭ই মার্চের মত আরেকবার বজ্র কন্ঠে ঘোষনা দেয়া যেন এই স্বাধীন দেশে জামায়াতে ইসলামী নামের কোন দল আর কোন দিন আত্মপ্রকাশ করার কথা স্বপ্নেও না ভাবে। এমন কোন দল যার সাথে রক্তের দাগ লেগে আছে যেন এই দেশে আর কেউ সমর্থন না করে। যদি করার চেষ্টা করে তাহলে তার শাস্তি হবে অনেক কষ্টকর মৃত্যু। এমন ঘোষনা এলে যে কেউ ভয় পেতো। তারপর যদি রক্ষী বাহিনী দিয়ে যেমন করে জাসদ, নকশাল দমন করা হয়েছে, সেই একই কায়দায় জামায়াত খুঁজে খুঁজে দমন করা হত, তাহলে জামায়াত এত বড় শক্তিশালী দল হতে পারতো না।

জাসদের গনবাহিনীও জামায়াত ধ্বংসের ফরজ কাজটা করে দেশের বিরাট উপকার করতে পারতো তাদের অন্য কাজের পাশাপাশি। কিন্তু তাদের এজেন্ডায় মূলতঃ মুজিব সরকার উৎখাত আর নিজেদের পছন্দের মানুষদের ক্ষমতায় নেয়া ছাড়া অন্য কোন কিছু ছিল না।

যদি শুরুতে জামায়াতের দিকে মনোযোগ দেয়া হত, তাহলে আজকের জামায়াত যে আকৃতি এবং প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে তেলাপোকার মত, সেটা সম্ভব হত না। তেলাপোকা তথা জামায়াতকে শুরু থেকে বংশ বিস্তার করতে দেয়া হয়েছে বিনা বাধায়।

শুধু অন্ধভাবে গালি গালাজ করে কি লাভ হবে ! জামায়াত এখন মহীরুহ এবং তার জন্য দেশ সৃষ্টির সাথে জড়িতরা সবাই দায়ী। জামায়াত তেলাপোকার মত দলে সদস্য রিক্রুট করে গেছে নিয়মতান্ত্রিকভাবে। শুধু তাই নয়, তাদের ভরন পোষন দিয়ে গেছে। ধীরে ধীরে বছরের পর বছর নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করে গেছে।

আমাদের দেশের মানুষ খুব ধর্ম ভীরু। জামায়াত এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়েছে শত ভাগ। ওরা রিক্রুট করেছে গরিব মানুষদের। মাদ্রাসায় পড়তে যায় দেশের সব চেয়ে গরীব, অনাথ, এতীম ছেলেরা। গ্রামের কম শিক্ষিত মানুষের বদ্ধমূল ধারনা, মাদ্রাসায় পড়া মানে আল্লাহর শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া। তার উপর জামায়াত এদের খুব কাছাকাছি গেছে মিষ্টি কথা, ধর্মীয় কথা বলে, আর্থিক সাহায্যের হাত নিয়ে।

শুধু রিক্রুট করে ক্ষান্ত হয় নাই। প্রতিটা সদস্যকে দলের আদর্শে এমনভাবে ট্রেইনিং দিয়েছে যে এরা দলের জন্য জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে পারে। সবাই জীবন দিয়ে হলেও দলের ডিসিপ্লিন মেনে চলে এবং সব কিছু গোপন করতে জানে। এরা দলের নেতার অনুমতি ছাড়া নিজের এলাকা পর্যন্ত ত্যাগ করে না। বাংলাদেশে এত নিয়মতান্ত্রিক দল আর দ্বিতীয়টা নাই।

আওয়ামী লীগ দেশের সবচেয়ে পুরনো কিন্তু কট্টরবাদীদের দল। যারা দলের নীতি নির্ধারক তারা নিজেদের দেশের একমাত্র চিরস্থায়ী উত্তরাধিকার ভাবে। মূল উদ্দেশ্য যেহেতু শুধুই ক্ষমতা এবং ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য এরা দেশী বিদেশী যে কারো সাহায্য নিতে প্রস্তুত থাকে। কিন্তু বেমালুম ভুলে যায় দেশের মানুষের কথা। দলের গঠনতন্ত্রে গনতন্ত্রের কথা লেখা থাকলেও বাস্তবে সব কিছুই চিরস্থায়ী সভাপতির একক সিদ্ধান্তে হয়ে থাকে। নিজেদের দেশের একমাত্র রক্ষাকারী দল ভাবলেও এরা প্রয়োজনে চরম শত্রুর সাথেও হাত মিলিয়ে ফেলে।তাই নব্বইএর এরশাদ হটাও আন্দোলনে বিএনপি ছাড়াও জামায়াতের সাথে হাত মেলাতেও দ্বিধা করে নাই । তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতেও জামায়াতের সাথে যুগপৎ আন্দোলন করেছে এই দল।আবার যে এরশাদকে হটানোর জন্য তারা রাস্তায় আন্দোলন করেছে, ২০০৯ এ তাকে সাথে নিয়ে সরকার গঠন করেছে এই দল। এখানেই দেখা যায় তাদের চেতনাবোধ কতটা স্বচ্ছ।

দল হিসাবে বিএনপি তুলনামূলক ভাবে মডারেট। যদিও এখানেও একক নেতৃত্ব বিদ্যমান। বিভিন্ন দল ত্যাগী বঞ্চিত, লোভী মানুষেরা এই দলে এসেছে নানা রকমের প্রলোভনে। দলের প্রধান নিজে রনাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা হয়েও স্বাধীনতা বিরোধী অনেক রাজাকারকে নিজের দলে প্রতিষ্ঠা করেছে। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হল, চিহ্নিত রক্তমাখা হাতের যুদ্ধাপরাধীদের দেশের মন্ত্রি সভায় স্থান দিয়ে তাদের গাড়িতে দেশের জাতীয় পতাকা তুলে দিয়ে শহীদদের প্রতি চরম অন্যায় করা হয়েছে। দুর্নীতির বেলায় দুইটা বৃহৎ দলই যৌথ চ্যাম্পিয়ন ট্রফি পাবে। শুধু যদি যুদ্ধাপরাধীদের নিজের দলে জায়গা না দিতো তাহলে এই দলের গ্রহনযোগ্যতা মানুষের কাছে চিরদিন সবচেয়ে বেশি থাকতো।

এরশাদ নাকি দেশের একমাত্র স্বৈরাচার। তাহলে তাকে সাথে নিয়ে সরকার গঠন করাতো জামায়াতকে সাথে রাখার চাইতেও বড় অপরাধ। কিন্তু এই ব্যাপারটা নিয়ে দেশের বিভ্রান্ত সৃষ্টিকারী সুধী সমাজ কোন কথা বলে না। কারণ, এরা সবাই আসোলে পরীক্ষিত দালাল। একটা সুযোগ পেলেই ডিগবাজি খাবে যে কোন সময়ে। তাই দেশের মানুষ নিরুপায় হয়ে দুই বৃহৎ দলের পিছনেই হাঁটে। আর কারো মিষ্টি কথায় কান দেয় না।

সুযোগ থাকা সত্বেও আওয়ামী লীগ জামায়াতকে নিষিদ্ধ করবে না। কারণ, তাহলে দাবা খেলার আর কোন গুঁটি থাকবে না। উপরন্ত, জামায়াত এখন বিএনপি’র জোটে। নিষিদ্ধ করলে তখনো বিএনপি’র সাথেই থাকবে, আর এটা আওয়ামী লীগ চায় না।

জামায়াত সবার কাছে কাগজে কলমে ঘৃনিত দল। অবাক কান্ড হল, এই ঘৃনিত দল আস্তে আস্তে শাখা প্রশাখা বিস্তার করে দলীয় এবং আর্থিকভাবে এত মজবুত হয়েছে যে দেশের আর কোন দল অর্থের খেলায় এদের সাথে পারবে না। দেশের অনেক বড় বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান জামায়াতের কব্জায়। শুধু তাই নয় – শিক্ষা, স্বাস্থ ক্ষেত্রেও প্রভাব বিস্তার করে আছে। মুখে গালি দিলেও কাজের ক্ষেত্রে জামায়াতের স্পন্সর সবাই নেয় নির্লজ্জের মত। এরা তেলাপোকার আদর্শের দল। এদের সমুলে উচ্ছেদ করা যায়না ।

আমাদের দেশের মানুষের ধর্ম ভীরুতা দেখে আমার তো খুব ভয় হয়। কে জানে কবে জামায়াত এই সব ধর্ম ভীতু মানুষের মনে জায়গা করে নিয়ে কি অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলে। কারণ দেশের বড় দলগুলি দেশের শ্ত্রু নিয়ে আসোলে মাথা ঘামায় না। জাতীয় ইস্যুতেও একসাথে বসে কথা বলে না। ওরা যে কোন উপায়ে শুধু ক্ষমতায় থেকে যেতে চায় কিংবা পুনরায় ক্ষমতায় যেতে চায়। তার জন্য দেশের মানুষের কাছে ভোট চাওয়ার প্রয়োজন মনে করে না। বাহুবল কিংবা দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে হলেও এরা সারাক্ষন ক্ষমতার কথাই ভাবে, দেশের কথা নয়। জামায়াতের মত ঠান্ডা মাথার প্ল্যানার’রা এই সব জাতীয় দুর্বলতাকে বেছে নেয়, কাজে লাগায় – এটা নিয়ে ভাবার তো কেউ নাই আমাদের দেশে। কত বড় দুর্ভাগ্য আমাদের।

আমাদের দুর্ভাগ্য আরো দৃশ্যনীয় হয় যখন দেখি প্রতিবেশী দেশ ভারতের আভ্যন্তরীন শাসন ব্যবস্থা এবং বৈদেশিক নীতি। ভারতে যারাই ক্ষমতায় থাকুক, যে যাই ভাবুক আসল সত্যি হল ওরা নিজেদের দেশের স্বার্থের বাইরে এক পাও এগুবে না। কংগ্রেস না বিজেপি ওদের রাষ্ট্র ক্ষমতায়, তাতে তাদের জাতীয় নীতির বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয় না।

ওরা আমাদের সাথে বন্ধুত্বের কথা বলে যাবে, অনেক আশা দিয়ে যাবে। কিন্তু কিছুই পূরন করবে না, বরং ওদের যা কিছু প্রয়োজন সেটা ঠিক আদায় করে নিবে। এটাই হল দেশপ্রেম। বাঙ্গালী দেখেও কিছু শিখলো না। অথচ মিথ্যা প্রলোভন আর হাওয়াই মিঠাই’র লোভে কত জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে ফেলে।

নরেন্দ্র মোদী এক সময় আমেরিকার ভিসা পেতো না। কিন্তু ইলেকশনে জেতার পর বারাক ওবামা নিজেই চলে এলো মোদীর সাথে দেখা করতে। নিউইয়র্কে ভারতীয় কন্স্যুলারের গৃহ ভৃত্য কেলেঙ্কারীর ঘটনায় তাকে আরেষ্ট করা হলে ভারতের পররাষ্ট সচিব আমেরিকান এম্ব্যাসীর লোকাল সিকিউরিটি সরিয়ে নিয়েছিল যা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। দেখা গেছে, ওবামা ভারত থেকে ঘুরে আসার পরই সেই সচিব বরখাস্ত হয়ে গেলো ।

দেশের বৃহৎ স্বার্থে এরা অনেক কিছু উৎস্বর্গ করে দেয়। শুধু আমাদের দেশে বৃহৎ শক্তির সাথে সত্যিকারের বন্ধুত্ব করার কোন দৃষ্টান্ত নাই। বরং উলটা পালটা কথা বলে সম্পর্ক আরো তিক্ত করে ফেলে।

এর কারন কি জানেন ? কারন একটাই, যারা ক্ষমতায় যায়, এরা দেশের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবে না। ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা ভাবে না। ভাবে শুধুই নিজের ভবিষ্যতের কথা। তাই করুন পরিনতি নিয়ে বিদায় হয় এরা এক সময়। ইতিহাস তাই বলে ।

মুরাদ হাই,
১৯ শে ফেব্রুয়ারী, ২০১৫