এক বৃষ্টি রাতের মধুর সময়  ও অমৃতসম  ডিনারের গল্প

বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। বারান্দায় গিয়েছিলাম বৃষ্টি দেখতে। বাতাসের সাথে পানির ঝাপটা এসে ভিজিয়ে দিলো।
ঘুটঘুটে অন্ধকার বাইরে। নিকষ কালো রঙের। শুধু বৃষ্টি আর বাতাসের শব্দ শুনি। আরাম লাগছিলো না বারান্দায়। তাই টুপ করে রুমে ঢুকে গেলাম।

রাত বাড়ছে। বৃষ্টি থামছে না। ক্ষুধা পেয়েছে আমার। জাকিরের ডায়বেটিস আছে। সে না খেয়ে থাকতে পারে না। খোকারও ডায়বেটিস। কিন্তু সে বৃষ্টির ভিতর বাইরে গিয়ে খেতে রাজী না। মাসুদ বেটা চুপ করে আছে। কম কথার মানুষ। আমরা যে যা বলি সে নীরবে সব মেনে নেয়। আসোলে বেশী ভালো মানুষ সে।

খোকা বলে, এক রাত না খেলে কিছু হবে না। ঢাকা থেকে আনা চানাচুর আছে। খেয়ে পানি খেয়ে শুয়ে থাক।

পাগল নাকি ! না খেলে আমার ঘুই আসবে না। তাছাড়া বেড়াতে এসেছি। প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ করতে চাই আমি। প্রতি বেলায় মজার খাবার খেতে চাই। ভ্যাকেশনে আছি। সো নো ডায়েট। নো বাচবিচার।

আমি বললাম, তোরা না খেলে না খা। আমাকে খেতেই হবে কিছু।

খাবি কই ! এই হোটেলে কিন্তু কোন ডাইনিং সার্ভিস নাই রাতে। আমি জেনে বলছি – খোকা বলে।

না থাকলেও সমস্যা নাই। হোটেলের বাইরে গিয়ে খাবার আনবো।

খোকা বলে – এইটা একদম রিমৌট গ্রাম। এখানে সন্ধ্যের পর কিছু খোলা থাকে না। কিচ্ছু পাবি না। তাছাড়া বাইরে বেরুলে ভিজে গিয়ে নিউমোনিয়া বাজাবি কিন্তু।

হু কেয়ারস এবাউট নিউমোনিয়া। যাই, গিয়েই দেখি, বলে আমি মাসুদের কিনে দেয়া সোয়েট শার্টটা পরে নিলাম। সামার হলেও বৃষ্টির কারণে শীত শীত লাগছে। ছাতা নাই। মাথায় হ্যাট পরে, পায়ে জুতা গলিয়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি।

জাকির লাফ দিয়ে উঠে বলে, দাঁড়া, আমিও যাবো তোর সাথে। আমাকে তো খেতেই হবে। নইলে ব্লাড সুগার লো হয়ে যাবে।

দুজন মিলে চারতলা’র রুম থেকে নীচে নেমে লবিতে আসলাম। কাউন্টারে একজন মহিলা আর কমবয়েসী একটা ছোকরা নাইট ডিউটি করছে।

জিজ্ঞেস করলাম, আশে পাশে ভালো রেস্তোরাঁ কোথায় আছে, বলো !

ব্রোকেন ইংলিশে উত্তর দেয় মহিলা – উহু, এতো রাতে সব বন্ধ হয়ে গেছে। তাছাড়া বৃষ্টি হলে আগেই বন্ধ হয় সব। এমনিতে সন্ধ্যার পর মেলা বসে পাশের পার্কিং লটে। ওখানে অনেক খাবারের স্টল থাকে। আজ বৃষ্টির জন্য সব পন্ড হলো। তবে আমার কাছে নুডলসএর প্যাকেট আছে। তোমরা চাইলে মাইক্রোওয়েভে গরম করে খেতে দিতে পারি।

আন্তরিকতায় খুশী হলাম।

মাথা নেড়ে বলি – ওসবে পোষাবে না। ছাতা থাকলে দাও। ঘুরে দেখে আসি।

সাথে সাথে ঢাউস সাইজের দুইটা ছাতা বের করে দিলো। ফ্ল্যাশলাইট দিলো অন্ধকার রাস্তায় দেখে চলার জন্য। মানুষগুলির এতো বেশী আন্তরিকতা আর সৌজন্যবোধের জন্য এই দেশটা আমার এতো ভালো লাগে। ইনফ্যাক্ট নিজের জন্ম নেয়া দেশ এবং গত ত্রিশ বছরের আবাস দেশটার চেয়েও অনেক বেশী আপন লাগে ওদের দেশটা। তাইতো বার বার গিয়েও খারাপ লাগে না একটুও। বরং থেকে যেতে ইচ্ছা করে।

ছাতা আর ফ্ল্যাশলাইট হাতে বের হলাম আমি আর জাকির। যাদের নাম বললাম এরা সবাই আমার ঢাকা ভার্সিটির জিগরি বন্ধু। প্রতি বছর এই বিচ্ছুগুলির টানে আমি কখনো ঢাকা, কখনো চায়না আবার কখনো থাইল্যান্ডে চলে যাই বিশ বাইশ ঘন্টা কষ্টকর জার্নি করে।

এবারও এসে মিট করেছি চায়না হয়ে থাইল্যান্ডের হুয়াহীন নামের এক নিঝুম গ্রামের তারচেয়ে নিঝুম এক হোটেলে। পাশে বনজঙ্গল। ঝাউ বন। পুকুরে লাল গোলাপী শাপলা ফুল ফুটে আছে। কলাগাছে ইয়া বড় কলা ধরে পেকে আছে। রুমে বসে সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ শুনি। সকালে মোরগের ডাক, রাতে বৃষ্টির টুংটাং সুর। সেই পরিবেশে বন্ধুরা মিলে পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন, হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিয়ে নাইন কার্ড খেলা আর পয়সা চুরি নিয়ে ঝগড়া করা আমাদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় পঁয়ত্রিশ বছর পেছনের হল লাইফে।

নস্টালজিক হই সবাই। মনে থাকে না সবার অনেকগুলি করে লেজ আছে যার যার ঘরে। আছে অনেক দায়িত্ব। আগে থেকে পরিকল্পনা করে আয়োজন করা আমাদের এই বাৎসরিক মিলনমেলা সব দায় দায়িত্ব ভুলিয়ে দেয় বেমালুম। আমরা সবাই হয়ে যাই তখন ছন্নছাড়া যুবকের মতো।

ছাতা মাথায় দিয়ে বৃষ্টির পানিতে চপচপ আওয়াজ তুলে নীরব রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটছি দুই বন্ধু। মনে করার চেষ্টা করছি সকালে মর্নিং ওয়াক করার সময় কোথায় কোথায় রেস্তোরাঁ দেখেছি। কিন্তু সবই বন্ধ দেখি। কোথাও বাতি পর্যন্ত জ্বলছে না।

জাকির বলে, কি রে কাউরে তো দেখি না ! এতো নীরব কেন সব ? ডর লাগে তো রে।

ধুর বেটা, ডরাস ক্যান ! এইটা কি তগো ঢাকা নাকি যে ঘর থেইকা একা বাইর অইলেও ঠ্যাক দিবো। এখানে এরা টুরিস্টদের পূজা করে। গরিব হইলেও চোর চ্যাচ্ছর না। তুই ওদেরকে রেসপেক্ট করবি, ভাল ম্যানার দেখাবি, দেখবি ওরা তোকে অনেক সন্মান দেবে। আর যদি খামোকা তেজ দেখাস আর আজাইরা ভাব লছ ঢাকার মতো, তাইলে কিন্তু পিটায়া মাইরা ড্রেইনের ভিতর লাশ ফেলে দেবে। কেউ খুঁজেও পাবে না, মনে রাখিস।

আসোলে রে, তুই ঠিকই কইসস। মিষ্টি ব্যবহার করলে ওরা অনেক তোয়াজ করে দেখসি আমি।

কথা বলতে বলতে দুই পাশে তাকাতে তাকাতে হাঁটছি। হটাৎ একটা জায়গায় লাইট জ্বলছে, খেয়াল করে সেদিকে গেলাম। গিয়ে দেখি একটা রেস্তোরাঁ। সামনে প্লাস্টিকে লেমিনেইট করা মেন্যু বোর্ড রাখা। বৃষ্টিতে ভিজে গেছে। তবুও উঁকি ঝুঁকি মেরে বুঝতে চেষ্টা করলাম ওরা খোলা আছে কিনা। ভিতর থেকে হয়তো আমাদেরকে খেয়াল করেছে। একটু পর লম্বা সুদর্শন এক মানুষ বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে।

এইরে সেরেছে ! কোথায় এসে পড়লাম ! এতো দেখি শ্বেতাঙ্গ টাইপ মানুষ একজন। কই এসে ঢুকলাম ! তাইলে কি এটা রেস্তোরাঁ না ?

লোকটা এগিয়ে এসে চোস্ত ইংরেজিতে বলে, জেন্টেলমেন, ইটস রেইনিং আউট দেয়ার। প্লিজ, কাম ইনসাইড।
কথা শুনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।

বললাম, যাক অনেকদিন পর কাউকে পেলাম যার সাথে কনভার্সেশনে দোভাষী লাগবে না। সাইন ল্যাংগুয়েজ ব্যবহার করা লাগবে না। শুনে সে হো হো করে হেসে দিলো।
ভেতরে ঢুকে দেখি নাহ ভুল জায়গায় আসি নাই। ওটা একটা রেস্তোরাঁই। কিন্তু একজন কাস্টমারও নাই। আমাদেরকে ভদ্রলোক বসতে দিলো।

প্রশ্নবোধক চেহারা নিয়ে তার দিকে তাকালাম। সে বুঝলো।

নিজে থেকে বলা শুরু করলো – এটা আমার রেস্টুরেন্ট। আজ বৃষ্টির কারণে কোন বিজনেস নাই।

তারপর কার্টেসি দেখিয়ে বলে – কি খাবে বলো। চা না কফি !

বললাম, চা খাবো দুধ ছাড়া। সম্ভব হলে মধু দিয়ে।

ড্রেস পরা একটা থাই মেয়েকে ডেকে ইংলিশে বললো চা আনতে।

আমাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে – তোমরা কোত্থেকে এসেছো ?

বললাম কে কোথা থেকে এসেছি। এবার আমি জিজ্ঞেস করি – তুমি এই দেশে কি করছো !

তখন বলে, আমি ব্রিটিশ। বেড়াতে এসে এই জায়গাটা খুব ভালো লেগে যায়। একা মানুষ। কোন পিছুটান নাই। দেশ থেকে টাকা পয়সা নিয়ে এসে এখানে থেকে গেছি। এটাই আমার দেশ এখন।

চা নিয়ে এলো। সুন্দর কাপ পিরিচে করে পরিবেশন করলো। চুমুক দিয়ে প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। ভালো জাতের চা পাতা। বানানোতেও মুন্সিয়ানা আছে।

গল্প চলছে। কারো যেন কোন তাড়া নাই। আমি শুধু ফাঁকে একবার জানতে চাইলাম – আচ্ছা তোমার কিচেন কি খোলা আছে ! আমাদের রাতের খাওয়া হয় নাই এখনো। চারজনের খাবার লাগবে।

বলে, কোন অসুবিধা নাই। খোলা না থাকলেও খুলে বানিয়ে দেবো। তুমি কি কি খাবে মেন্যু দেখে অর্ডার দাও। ওরা বানাতে থাক আর আমরা সেই ফাঁকে গল্প করি।

অর্ডার দিলাম। সে শুধু ইনসিস্ট করলো ‘লার্বগাই’ অর্ডার দিতে। ওটা নাকি তাদের স্পেশাল আইটেম। সেটাও অর্ডার দিলাম।

আমার নিজের ভালো লাগে। তার কাছ থেকেও থাই জাতির গুণগান শুনলাম। তার মুগ্ধতা দেখে নিজেও মুগ্ধ হলাম।

কথায় কথায় সময় গড়ালো। ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। একসময় মেয়েটা সব খাবার ব্যাগে ভরে সামনে এনে রাখলো। বিল দিলো। দেখলাম চায়ের দাম নেয় নাই। দিতে চাইলাম। নিলো না। ভালো লাগলো মানুষটার আন্তরিকতা।

ওকে বললাম – মাইক, তোমার এখানে আমার জন্যে একটু জায়গা রেখো। দেখবে আমি একদিন ব্যাগ গুছিয়ে এখানে চলে আসবো। উন্নত বিশ্বের নোংরামো আর ভালো লাগে না।

সে হেসে বলে, ইউ উইল বি ভেরী ওয়েলকাম ইন মাই হাউজ, মেইট।

আবার দেখা হবে বলে হ্যান্ডশেক করে বিদায় নিলাম।

অনেকক্ষন হেঁটে হোটেলে এসে ঢুকলাম। লবি থেকে রুমে ফোন করে অলস দুইজনকে খেতে আসতে ডাকলাম নীচে।

অবাক করলো লবির মহিলাটা। হাত থেকে খাবারের প্যাকেটগুলি নিয়ে ডাইনিং এর বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে টেবিল সাজাতে শুরু করলো। এই কাজ তার করার কথা নয়। তবুও করছে।

খাবারের সুবাস পেয়ে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লাম বুভুক্ষের মতো। ভালো রান্না। খেয়ে শান্তি পেলাম। খুব মজা পেলাম অসাধারণ লার্বগাই’খেয়ে।

খোকাকে বললাম, কি রে, তুই না বলেছিলি খাবি না ! এখন তো ঠিকি খেলি বেটা।

সে চতুর হাসি দিয়ে বলে – দোস্ত, আসোলে বৃষ্টির ভিতর আমার হাঁটতে ইচ্ছা করছিলো না। তোদের যে এমন ইচ্ছা করবে সেটা ভাবি নাই। কিন্তু কষ্ট করে এমন মজার খাবার আনার জন্য থ্যাঙ্কস।

বৃষ্টি রাতের সেই অসাধারণ মুহূর্তগুলি এখনো মনের ভিতর আনাগোনা করে। মনে পড়ে গভীর রাতে বৃস্টি কমে এলে হটাৎ হটাৎ একটা দুইটা বৃষ্টির ফোটা উপর থেকে মাটিতে কলা পাতার উপর পড়ে যে আওয়াজ তুলছিলো , রাতের গভীরতায় সেই আওয়াজ সুরের মূর্ছনার মতো লাগছিলো, যে সুর শুনতে শুনতে একসময় ঘুমের দেশে তলিয়ে গিয়েছিলাম।

৯ই ডিসেম্বর, ২০১৭