আড্ডা

আড্ডাবাজ মানুষ আমি। পারলে পছন্দের মানুষদের সাথে প্রতিদিন আড্ডা দেই। দিতামও তাই। যতক্ষণ একা ছিলাম তখন প্রতিদিন আড্ডা হতো। দেশ এবং বিদেশে সবখানেই। একদিন আড্ডা না হলে দম বন্ধ হয়ে মরার মত অবস্থা হতো।

এস,এস,সি পরীক্ষা শেষে সেই যে কলোনীর সিঁড়িতে বসে আড্ডা দেয়া শিখলাম, আর ছাড়তে পারি নাই। নেশার মত হয়ে গেলো। বিকেল হলেই কাপড় পরে বারান্দায় গ্রিল ধরে তাকিয়ে দেখতাম গলির মুখে খোকনের সাইকেল দেখা যায় কিনা।

হ্যাঁ, প্রতিদিন বিকেলে শৈশবের প্রিয় বন্ধু খোকন তার সাইকেল চালিয়ে রামপুরা থেকে মগবাজারে আসতো আমাকে নিতে।
গরমের ভিতর ঘামে ভিজে চপচপে হয়ে এসে নীচে দাঁড়িয়ে হাঁক দিতো – অই,মুরাইদ্যা নাম।

তার সেই ডাক যেন আমার কানে মধু ঢালতো। এক ছুটে নেমে এসে ওর সাইকেলের রডে বসে পড়তাম। দক্ষ চালক খোকন রাস্তার গাড়ি ঘোড়ার ভিড় এড়িয়ে ঝড়ের বেগে সাইকেল চালিয়ে মতিঝিল কলোনির আড্ডায় গিয়ে পৌঁছুত আমাকে নিয়ে। তারপর মাঠে বসে আড্ডা চলতো রাত নয়তা/দশটা পর্যন্ত।

আহা,কি যে শান্তি লাগতো সেই আড্ডা।

তারপর আড্ডা থামে নাই কোনদিন। আড্ডার নেশায় ঢাকায় বাসা হয়েও হলে চলে গেলাম। তখন আর আড্ডা থামায় কে !
ক্যাম্পাস,নিজের হল,অন্য হল,শাহবাগ,এখানে সেখানে অবিরাম আড্ডা চলে।

আড্ডা দিতে দিতে একদিন শাহবাগে বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পরদিন সকালে আমেরিকায় রওয়ানা দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম,সাধের আড্ডাবাজি মনে হয় শেষ হল আমার।

না,কপাল আমার ভীষণ ভালো। আড্ডার কপাল আমার। আমেরিকায় এসে আড্ডার মানুষ খুঁজে পেতে সমস্যা হয় নাই। যেন আমার জন্যই আগে থেকে কিছু বন্ধু আমেরিকায় এসে অপেক্ষায় ছিল।

মাশুক,কামাল,মুনির,আলি,জামান এরা সবাই এক ক্যাম্পাসের, এক ব্যাচের হওয়ায় অন্তরঙ্গ হতে বেশী সময় লাগে নাই। কোনমতে সপ্তাহের পাঁচদিন কাজ করে শুক্রবার রাত থেকে আমাদের ম্যারাথন আড্ডাবাজি শুরু হয়ে যেতো।

প্রিয় নেশা আড্ডাবাজি নিয়ে জীবন ভালই চলছিল। কারো কোন পিছুটান ছিল না। ঘরে ফেরার তাড়া ছিল না। মোবাইল ফোন ছিল না। প্রেমিকা ছিল না। তাই আমাদের সবার আকর্ষণ ছিলাম আমরাই। আমাদের আড্ডাই ছিল সবার কাছে প্রিয় টনিক।

নাহ, বেশী সুখ কারো কপালে মনে হয় বেশী দিন সয় না। আমারো সইলো না।
বন্ধুত্বে ফাটল ধরাতে, দূরত্ব বাড়াতে সবচেয়ে সহজ কাজ হল কাউকে বিয়ে দিয়ে দেয়া।
ব্যস, সর্বনাশ হয়ে যাবে সাথে সাথে। সে হারিয়ে যাবে।

সে না চাইলেও পিছুটান,গলায় বাঁধা সংসারের অদৃশ্য দড়ি তাকে আড্ডা থেকে আস্তে আস্তে দুরে সরিয়ে নেয়। সরিয়ে নেয় প্রিয় বন্ধুদের কাছ থেকে।
একজন থেকে দুজন, একসময় সবাই বিয়ে থা করে সংসার পাতে। তখন আর ব্যাচেলর আড্ডা হয় না। হলেও ফ্যামিলি আড্ডাবাজি হয় সুশীল আলোচনা করে।

ইস,অমন সেন্সর করে কথা বলতে গেলে আমার মুখ ব্যথা হয়ে যায়। স্লিপ অফ টাং তো অহরহ হয়েই থাকে। বিশেষ করে ছেলেদের আড্ডার খুব কমন শব্দ ‘আমার বাল’ কথাটা কতবার যে মুখ ফসকে বের হয়ে ভেজাল বাঁধিয়ে ফেলেছি তার হিসাব নাই।

বুড়ো হয়ে গেছি। একশো মাইল স্পিডে ষাটের দিকে রেইস দিচ্ছি। জানি তো। এই বয়সে অনেক মানুষ ধর্ম কর্ম ছাড়া আর কিছু নিয়ে ভাবে না। প্রতি কথায় আল্লাহকে টেনে মাটিতে নামায়। সব কিছুতে খুব বাড়াবাড়ি। অস্থির লাগে। পারি না সবসময় অমন আঁটসাঁট জীবন কাটাতে।
কমবেশী সবাই নিজের পরিবার,পোলাপাইন, ব্যবসা, সম্পত্তি নিয়ে ব্যস্ত। ওসবই মুখ্য। বন্ধু গৌণ ব্যপার হয়ে গেছে। খুব অপমান লাগে। কষ্ট লাগে।

হ্যাঁ জানি তো, বুড়ো হয়েছি। তাই বলে কি সেটা লিখে কপালে সাইনবোর্ড লাগিয়ে ঘুরতে হবে নাকি ! নাকি সারাক্ষণ শুধু জায়নামাজে উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে হবে। ধর্ম
কর্ম তো যার যার ব্যাক্তিগত ব্যাপার। মাইক লাগিয়ে প্রচার করার কোন ব্যাপার না।

আসল সত্য হল চিত্তের শান্তি মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। কোন বদ্যি, কোন পথ্য পারে না মানুষকে বাঁচাতে। এই কথা কয়জনে মানি !

বাচ্চারা বড় হয়ে গেছে। নিজেদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। ওদের হাত ধরে রাস্তা পার করে দেয়ার সময় পার হয়ে গেছে। কাজ কমে গেছে। কিন্তু আমরা তো একদম একা হয়ে গেলাম। মানে যারা বন্ধুদের অবহেলা করে দুরে সরিয়েছে। তারা আর বন্ধুর মায়া,বন্ধুর টান অনুভব করে না।

আমি পারি না একা থাকতে। কখনোই পারি নাই। চেষ্টা করি সবাইকে জড়ো করতে। কখনো পারি, কখনো পারি না।

একা থাকতে ভাল লাগে না বেশীদিন। তাই সুযোগ পেলে কয় সপ্তাহর জন্য গায়েব হয়ে যাই একা একা। ঢাকায় চলে যাই। প্রিয় বন্ধুদের সাথে তুমুল আড্ডাবাজি করে ফুল রিচার্জড হয়ে ফিরে আসি।

আমার এমন কাণ্ড দেখে অনেকে ভ্রু কুঁচকায়। আমি থোড়াই কেয়ার করি। জীবন তো আমার। জীবন তো একবারই আসে। আর সেটা এতো কম সময়ের জন্য – জেনে শুনে কেমন করে আমি সেই ছোট্ট জীবনের সীমাবদ্ধ সময়টুকু অপচয় করতে যাবো।

কিন্তু সব সময় তো আর অমন যেতে পারি না। এখানে মনের মত কাউকে পাই না। তাই কত সুন্দর বিকেল, কত ছুটির দিন আজকাল একা কাটাই তার কোন হিসাব নাই।
টেলিভিশন, ফেইসবুক, বই পড়ে আর কত ভাল লাগে !

বোর হই। দম বন্ধ লাগে। প্রাণ খুলে হাসতে ইচ্ছা করে। সেন্সর না করে মুখে যা আসে বলতে ইচ্ছা করে। কিন্তু বলার মানুষ নাই। শুনার মানুষ নাই। সবার সাথে তো আর সবকিছু বলা চলেনা।

তখন ভাবি, আমি কত একা। মরার আগেই কবরে একা থাকার জন্য দুনিয়ায় যেন প্র্যাকটিস করা শুরু করেছি।
বেঁচে থেকেও মানুষ কেমন মরা মানুষের মত মুখে লাগাম পরে বসে থাকে, তার ভাল উদাহরণ মনে হয় আমি।

আমার বউ নিজেও আড্ডাবাজ। তার নিজের বন্ধু আছে। সে তার আড্ডা এঞ্জয় করে। তাই আমার আড্ডা নিয়ে তার কোন অভিযোগ নাই। সমজদার মানুষ। কিন্তু তাই বলে, এটা বলা ঠিক হবে না যে বিয়ের পর বউ মানুষের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু হয়। এটা ভুল কথা। ওরা বন্ধু বটে। ভিন্ন রকমের বন্ধু। সেই বন্ধুত্বে অনেক দাড়ি কমা থাকে।ড্যাশ থাকে। হিসেব করে কথা বলতে হয়। নইলে আগুণ লাগে। সেই আগুনে সব পুড়ে ছাই হয়।

তাই কেউ বন্ধুর সংজ্ঞা নিয়ে ভুল বিশ্লেষণ দিলে মেজাজ খারাপ লাগে। ওদের জন্য করুণা হয়। কারণ তারা জানেই না বন্ধু কি চিজ। বন্ধুর সঙ্গ কেমন পাগলা নেশা। যেই নেশা আর কিছুতে হয় না। হবে না। সেই নেশার স্বাদ যারা পেয়েছে, শুধু তারাই জানে।

২১শে এপ্রিল ২০১৮